Wednesday, October 2, 2019

স্টার কাবাব ও রেস্টুরেন্টের উত্থান

মাকসুদা আজীজ


উনিশ শ আশির দশকদেশে বেসরকারি ব্যাংকব্যবস্থা সবে বেড়ে উঠছেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ থেকে আটাশিতে মাস্টার্স পাস করে মীর আখতার উদ্দীনও চেয়েছিলেন, বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করবেনকরপোরেট জগতের গ্ল্যামার আর ঝাঁচকচকে অফিস খুব টানত তাঁকেকিন্তু বাদ সাধলেন বাবা; বসিয়ে দিলেন পারিবারিক বেকারি ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়। 
ছবি: হোটেল ষ্টার (প্রাঃ) লিমিটেড, ধানমন্ডি


এলিফ্যান্ট রোডের স্টার কাবাব ও রেস্টুরেন্টের ১১ তলায়, গোছানো অফিসে বসেই কথা হচ্ছিল মীর আখতার উদ্দীনের সঙ্গেঅফিস যতই চকচকে হোক, তিনি মানুষটা সাদামাটা; তাই প্রথমেই অনুরোধ, তিনি আসতে চান না ব্র্যান্ডিংয়ের বলয়ে, প্রচারে আর আলোয়; বরং কাজকে এগিয়ে নিয়ে তিনি নিজেকে রাখতে চান নেপথ্যের নিভৃত যতনেআখতার উদ্দীন শুরু করেন তাঁর গল্প, আমরা জন্মেছি, বড় হয়েছি একটি বেকারির মধ্যেফোল্ডার স্ট্রিটে আমাদের বাসার নিচেই ছিল বেকারি, ঠাটারীবাজারে দাদার একটা ছোট খাবারের দোকান ছিলসেটার উল্টো পাশে বাবা মীর মমতাজ উদ্দীন শুরু করেন তাজ বেকারি। 

১৯৬৫ সালের কিছু আগে বাবা করাচি থেকে চা বানানোর এক নতুন কৌশল শিখে আসেনসেই কৌশল এত জনপ্রিয় হলো যে সোসাইটি নামে একটি হোটেলই দাঁড়িয়ে গেল রাতারাতি’ সেই হোটেল খুব দ্রুত হাতছাড়া হয়ে যায় পারিবারিক সম্পত্তি ভাগাভাগিতে১৯৬৫ সালে ঠিক উল্টো পাশের বাড়িটি ভাড়া করে মমতাজ উদ্দীন শুরু করলেন স্টার হোটেল। 
পুরাতন: ষ্টার হোটেল

ইংরেজি নামের দোকানের চল তখন নতুন, স্টার নামটা খুব মন ধরল মমতাজ উদ্দীনেরতখনো ১৯৬৪ হিন্দুমুসলমান দাঙ্গার ক্ষত দগদগেমমতাজ সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁর হোটেল হবে সব ধর্মের মানুষদের জন্য, সেই থেকে আজও স্টার চলছে গরুর মাংসের কোনো পদ ছাড়াএভাবে ইতিহাসের পথে হাঁটলেন আখতার। স্বাধীনতার আগেই জয়কালী মন্দিরের কাছাকাছি জায়গা কিনে তৈরি হলো হোটেল সুপারআখতার জানালেন, বাবা ক্রমান্বয়ে এগোচ্ছিলেনআটাশিতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স থেকে পাস করার পর বাবা তাই আমাকে চাকরি করতে দিতে চাননিবলেছিলেন চাকরির চেষ্টা বাদ দিয়ে ব্যবসায় মন দিতেদেওয়া হয় ফোল্ডার স্ট্রিটের তাজ বেকারির দায়িত্বপরে প্রীতম ভবনের নিচের ফ্লোরের বেকারির দায়িত্বও বর্তায়তাই সকালে তাজ আর বিকেলে প্রীতম ভবনএভাবেই চলছিমাস দুয়েক বেগার খাটার পর বাবাই বেতন দিতে মনস্থ করলেনধার্য হলো মাসিক দুই হাজার টাকাপ্রথমটায় ঠিক মন ওঠেনি, পরে অবশ্য বেতন বাড়িয়েছেন বাবা, হাসতে হাসতে যোগ করেন আখতার। শুরুতে খুব একটা ভালো না লাগলেও বেকারির সৌরভ মৌতাত বোনেবিশেষ করে জন্মদিনের ক্রিম দেওয়া কেকটা বেশ মনে ধরে যায় তাঁরক্রমেই নিজেকে অভিযোজিত করে নেন বেকারি আর রেস্তোরাঁ ব্যবসা আর ব্যবস্থাপনায়পঁচানব্বই সালে এসে বাবাছেলে মিলে কারওয়ান বাজারে তৈরি করলেন হোটেল সুপার স্টারখাওয়ার সঙ্গে থাকার ব্যবস্থাওঠিক সুপারের মতোই। 

এরপর একে একে ধানমন্ডি, সাতমসজিদ রোড, বনানী, এলিফ্যান্ট রোড, সবশেষে জনসন রোডে...ডালপালা ছড়িয়েই চলছে স্টারের বেকারি, কাবাব ও রেস্টুরেন্ট। মীর আখতার উদ্দীনসময়ের হিসাব করলে স্টার বেকারি, কাবাব ও রেস্টুরেন্টের বয়স ৫৪ বছর; এত দিনেও কেন পা রাখেননি ঢাকার বাইরে? প্রশ্ন শুনেই সুখী মানুষের হাসি হাসেন আখতারবলেন, আমরা আসলে নিজেদের জমির ওপর ছাড়া নতুন শাখা খুলতে চাই না, আমাদের আগুন-পানি নিয়ে কাজ, বাণিজ্যিক ভবনের সুযোগ-সুবিধা ছাড়া শুরু করতে চাই নাসম্পূরক প্রশ্ন আসে, দেশের বাইরে? সেই জবাব অবিকলতবে পরবর্তী প্রজন্ম যদি চায়, চাইলে সেটা হতে পারেকিন্তু আমার কোনো ইচ্ছে নেই দেশের বাইরে যাওয়ার’ এলিফ্যান্ট রোডে স্টারের সবচেয়ে ওপরের তলাটাজুড়ে স্টারের রান্নাঘরআখতার উদ্দীনের সঙ্গী হই আমরাঘুরিয়ে দেখান সবকিছুসঙ্গে চলে ধারাবর্ণনাজানান, শুধু কাবাব অংশ নিচে, বাকি পুরো রান্নাই এই রান্নাঘরে হয়প্রতিটা শাখারই নিজের একটি করে রান্নাঘর আছেবিশাল সেই রান্নাঘরে ঢুকতেই ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঠিকই চিনে নেয় স্টারের চিরচেনা কাচ্চি, লেগ রোস্টের সুবাস; বিশাল ডেকচিতে ঠন ঠন শব্দ তুলে একদল মাংসে মসলা মাখাচ্ছে; অন্যদিকে কেউবা পেঁয়াজ কাটছে; সারি ধরে ১৭টি উনুনকোনোটায় দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে, কোনোটায় বসেছে কাচ্চিরাঁধুনিদের বিশাল বাহিনী থাকলেও মূল বাবুর্চি মাত্র চারজন; রন্ধনের আধুনিক অভিধানে যাঁরা মাস্টারশেফবাকিরা সহযোগীশুধু এই রান্নাঘরেই প্রতিদিন আদা-রসুন বাটা হয় ৮০ কেজির মতো; এ থেকেই বোঝা যায় প্রতিদিনের রান্নার পরিমাণ! বাজারের প্রসঙ্গে আবার ফিরে যান পুরোনো কথায়মুক্তিযুদ্ধের পরপর যখন দেশে চরম খাদ্যাভাব, বেকারি ব্যবসার কাঁচামাল জোগাড় করতে হিমশিম খেতেন আখতারের বাবা মমতাজ উদ্দীনতখন নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ময়দা, চিনি, তেলের সরবরাহ পাওয়া যেত না; বাবা সকাল সকাল উঠে চলে যেতেন, কখনো কখনো সারা দিন লেগে যেত লম্বা লাইন পার হয়ে কাঁচামাল সংগ্রহেতাই দিয়েই টিকে থাকতে হতো বাজারে’ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে অনেকগুলো বছর কাচ্চির বাজারে প্রায় একচেটিয়া বাণিজ্যের পর এসেছে অনেক প্রতিযোগী; এ নিয়ে কিছু চিন্তিত হলেও আখতার উদ্দীন খুব বদল চান না ব্যবসাকৌশলে

ছবি: হোটেল ষ্টার (প্রাঃ) লিঃ

বরং বললেন, আমি আসলে খুব বেশি কিছু চাই নাআমরা মূলত মধ্যবিত্তদের কাছে পৌঁছাতে চাইতাদের সাধ্য অতিক্রান্ত হোক, এটা কখনো চাই না আমরাশুধু মধ্যবিত্ত না, নিম্নবিত্তদের জন্যও খোলা স্টারের আটটি শাখার দুয়ারমাত্র ৩৫ টাকার বিনিময়ে সেখানে  পেটচুক্তিতে ভাত, ডালের সঙ্গে একটি আমিষ তরকারি পরিবেশন করা হয়সেখানে প্রতিদিন মাছ, ডিম বা গিলা-কলিজার কোনো এক পদ পরিবেশন করা হয়বনানীতে আলাদা এক হাজার স্কয়ার ফুটের জায়গা রাখা হয়েছে এই খাবার পরিবেশনের জন্যআখতার বলেন, এই ব্যবস্থাটা বাবাই শুরু করেছিলেনখাবারের দোকানে ক্ষুধার্ত মানুষের জায়গা হবে না, তা কি হয়? বনানীর মতো খরচের জায়গায় সাধারণ মানুষের সামর্থ্যে খাবার জোগাড় করা অনেক কঠিন, সেখানে অনেক সময় শিক্ষার্থীদেরও দেখা যায় এসে খেতে’ পারিবারিক ব্যবসা খাবারের হলেও লেখাপড়ার বিষয়েও খুব সজাগ ছিল আখতার উদ্দীনদের পুরো পরিবারচার বোন, এক ভাই প্রত্যেকেই লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেএক বোন শুধু সরকারি চাকুরে, বাকি সবাই আছেন রেস্টুরেন্ট নয়তো বেকারি ব্যবসায়সবটাই চলে অভিন্ন ব্যবস্থাপনায়।  বাবার অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজের অর্জিত জ্ঞানতা দিয়েই এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছেনতবে ভবিষ্যৎ হয়তো অন্য পথে চলবেযার পুরোটার নিয়ন্ত্রণও তাঁর নিজের হাতে নেইকারণ, উত্তর প্রজন্ম হাল ধরবেতা নিয়েই তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতবললেন, বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়া থেকে মাত্র বিবিএ পাস করল; ইচ্ছে আছে ছোট ছেলেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়ানোর; বোনদের সন্তানেরাও বড় হচ্ছেতারা যখন হাল ধরবে সময় আরও বদলাবেসময়ই বলবে স্টার কোথায় যাবেআপাতত আমি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাজার নিয়ে আশাবাদী আর তৃপ্তসবাই মিলে কাজ করলে আমরাও এগোব; আর দেশও’ সংগ্রহীত: দৈনিক প্রথম আলো।



No comments:

Post a Comment